রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংঘাতের উসকানি ছিল একাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের!

ডেস্ক রিপোর্ট :

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে বাংলাদেশকে সংঘাতে জড়ানোর উসকানি শুধু মিয়ানমার একাই দেয়নি, ‘শক্তিশালী কিছু বন্ধু রাষ্ট্রও’ দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের একটি বক্তব্য থেকে এমন ইঙ্গিত মিলেছে।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর মিয়ানমার বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। তবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সেই উসকানিতে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টা চালিয়েছে। এরপর কিছু বন্ধু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মহড়ার মতো সামরিক উদ্যোগের পরামর্শে বাংলাদেশের সাড়া না দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে এ দেশ প্রকৃত অর্থেই শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে চায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের আসন্ন বৈঠক নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। একটি প্রশ্ন ছিল, ‘আগামী মাসের শুরুতে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আমরা একটু শক্ত অবস্থান নেব, নাকি আগের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থান রাখব?’

জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে। সমাধানও তারাই করতে পারে।

শক্ত অবস্থান মানে কি আপনি যুদ্ধ করতে যাবেন? আমরা যুদ্ধ করব না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করব। আমাকে কেউ কেউ উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন—তোমরা যদি চাও আমরা সেখানে কিছু একটা মহড়া-টহড়া করতে পারি। আমাদের পথ খোলা আছে।’
‘কেউ কেউ’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অত্যন্ত শক্তিশালী লোকজন।’ এরপর সাংবাদিকরা জানতে চান, ‘ব্যক্তি, না দেশ?’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব দেন, ‘দেশ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এটাকে খুব একটা পাত্তা দেই নাই। কিন্তু আমাদের বলেছেন, তোমরা চাইলে আমরা তোমাদের হয়ে ক্ষমতা দেখাতে পারি।’ এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, ‘টেকনাফ বা সেন্ট মার্টিনসে ঘাঁটি করে?’ মন্ত্রী বলেন, ‘না, এগুলো নয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সুনির্দিষ্টভাবে ওই বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর নাম বলেননি। গত ৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সফরে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রুনেই ও আর্জেন্টিনা গেছেন। এ ছাড়া আরো অনেক দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ হয়েছে। এসব সাক্ষাৎ ও আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে আগামী রবিবার রাশিয়া যাচ্ছেন। সেখানেও রোহিঙ্গা সংকট গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে।

সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক অ্যান্তোনিও ভিতোরিনো এবং জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ক ও মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকককে কী বলেছেন জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি তাঁদের মিয়ানমারে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে এবং রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তাঁদের বলেছি, বাংলাদেশে সব ঠিক আছে। আপনারা মিয়ানমারে যান। সেখানকার পরিস্থিতি ঠিক করুন।’

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র কোন কোন দেশ জোগান দিয়েছে, শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলাকারীদের কারা হামলার রসদ দিয়েছে, তা খুঁজে বের করার আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরকে প্রস্তুত করেছে। সেখানে গেলে রোহিঙ্গারা লাভবান হবে। বর্ষা মৌসুম আসছে। কক্সবাজারে পাহাড়ধসের ঝুঁকি রয়েছে। পাহাড়ধসে রোহিঙ্গারা হতাহত হলে এর দায় বাংলাদেশ নেবে না। বরং যারা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে, তাদের এই দায় নিতে হবে।

এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে মার্ক লোকক সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে উৎসাহিত করতে জাতিসংঘ সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আইওএমের মহাপরিচালক অ্যান্তোনিও ভিতোরিনো রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য কাজ অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেন। ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর দপ্তর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। শিগগির তিনি মিয়ানমার সফরে যেতে চান এবং তখন রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিও দেখতে চান।

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমানের সঙ্গে জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, কক্সবাজারে যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে স্থানীয় জনগণের সমস্যা হচ্ছে, তাদের জন্য আলাদাভাবে প্রকল্প নেওয়া হবে বলে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনার বিষয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলটি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গতকালই কক্সবাজার গেছে। সুত্র: কালেরকন্ঠ